পেটগুড়গুড় বাঙ্গালির চিরতরের সাথি তালমিছরি, এবং এই স্বাদু জিনিসটির সাথে যে নামটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তা হল দুলাল চন্দ্র ভড়। বাঙ্গালিকে শুধু ব্যবসা নয়, তালমিছরির স্বাদও চিনিয়েছিলেন এই মানুষটিই। বাঙালি ব্যবসা করতে জানে না। এই বহু প্রচলিত বাক্যটি দুলাল চন্দ্র ভড় ভুল বলে প্রমাণ করেছিলেন। এবং আজও বাঙলার ঘরে ঘরে ‘দুলাল চন্দ্র ভড়’ নামাঙ্কিত ছোট প্লাস্টীকের হলুদ বোতলটি অতি পরিচিত একটি বস্তু।
বাঙ্গালির ব্যবসার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় নাম দুলাল চন্দ্র ভড়। তিনি তাঁর ব্যবসায় সর্বোচ্চ স্থান দাবি করেছিলেন কোনও মার্কেটিং, সেলসম্যান, বা চটকদার ব্র্যাণ্ড অ্যাম্বাসাডর ছাড়াই। আসুন জেনে নেওয়া যাক তাঁর কাহিনী।
শুরুর দিকের গল্প
এক মাথা টাক এবং মুখে বিনম্র হাসি। তালমিছরির বোতলের এই বৃদ্ধ মানুষটির ছবিটি অতি পরিচিত। ছবিটি প্রয়াত দুলাল চন্দ্র ভড়ের। ওনার যাত্রা শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। তখন ওনার বয়স বছর উনিশ হবে। ভড়েদের তখন কলকাতায় কাপড়ের ব্যবসা। হাওড়া হাটে তখন ওনাদের অনেকগুলি দোকান। এবং কাপড়ের ব্যবসাও তখন তুঙ্গে। তরুণ দুলাল তখন বাবা কাকার সাথে দোকানে যাচ্ছেন মাঝে মাঝে, ভিড়ে ঠাসা দোকানে ওনাদের সাহায্য করতে।
তরুণ দুলালের কিন্তু বেশি দিন কাপড়ের ব্যবসায় মন টিকল না। নিজের কিছু করবার তাগিদ খুব বেশি ভাবে নাড়া দিচ্ছিল তাকে। বাংলায় তখন সাদা মিছরির চাহিদা তুঙ্গে। দুলাল দেখলেন এই ভালো সময়। তরুণ দুলাল মিছরির ব্যবসায় ঝাঁপ দিলেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যবসা জমে গেল। কিন্তু তাতেও তার মন বেশিদিন টিকল না। ওনার উচ্চাকাঙ্ক্ষী মন যেন একান্ত নিজের কিছু চাইছিল। এবং কিছুদিনের মধ্যে তা পেয়েও গেলেন দুলাল চন্দ্র ভড়।
ভড়েদের পৈত্রিক ভিটে ছিল হুগলি জেলার রাজবলহাটে। চার বিঘার উপরে ওনাদের বসতবাড়িটিতে ছিল তাল গাছের ছড়াছড়ি। কিছুদিনের মধ্যেই দুলাল বুঝলেন উনি কিসের ব্যবসা করবেন – তালমিছরি। তালগুড় থেকে তৈরি এই মিছরিই হয়ে উঠল দুলাল চন্দ্র ভড়ের নতুন ব্যবসার সামগ্রী। এবং, প্রাকৃতিক ভাবে উৎপন্ন তালগুড়ই হয়ে উঠল ওনার ব্যবসার মূল উপকরণ।
তালমিছরির ব্যবসা তখন সবে শুরু হয়েছে বাংলায় কিছু ছোট বাঙালি ব্যবসায়ির হাত ধরে। অল্পদিনের মধ্যেই দুলাল চন্দ্র উৎপাদন ও বিতরণ এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন যে তালমিছরির ব্যবসায় উনি হয়ে উঠলেন একছত্র অধিপতি।
ট্রেডমার্কের প্রচলন তখন খুব বেশি ছিল না। তবু তাঁর জিনিস একান্ত ভাবে তাঁরই কেন হবে না! এই ধারণা নিয়ে উনি ব্রিটিশদের আস্থা অর্জন করলেন, এবং অল্প সময়ের মধ্যেই রেজিস্ট্রেশণ নম্বর পেয়ে গেলেন। সেই একই নম্বর ‘৩৯৬৫,’ আজও ব্যবহৃত হয়ে চলেছে দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরির বোতলে।
দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরির কেন এত চাহিদা
প্রয়াত দুলাল চন্দ্র ভড়ের ছেলে এবং ব্যবসার উত্তরাধিকারী ধনঞ্জয় ভড়ের মতে, তাদের পণ্যের ব্যাপক চাহিদার মূলে রয়েছে তমলুক থেকে খাঁটি তালের গুড় ব্যবহার। বিকল্প হিসাবে কোন নিম্ন মানের উপাদান ব্যবহার করা হয় না। দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরির উচ্চতর চাহিদার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে গুণমান নিয়ন্ত্রণ।
তাল গাছ থেকে প্রাপ্ত রসই হল মূল উপাদান যা গুড় তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি থেকে জ্যৈষ্ঠের শেষ, এই কয়েক মাসই তালের রস সংগ্রহের সময়। সংগ্রহের পরে, তা ড্রামে ফোটানো হয় একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় না পৌঁছানো পর্যন্ত। এরপর, ঘন রসটি পাত্রে ঢেলে ঘনিভূত করার জন্য রেখে দেওয়া হয়। প্রায় এক সপ্তাহ পরে, উপরে এবং নীচের স্তরগুলিতে স্ফটিক তৈরি হতে শুরু করে। তারপর সেই স্ফটিকগুলি কেটে বোতলজাত করা হয় ব্যবহারের জন্য।
যারা দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরি খায় তারা এর উপযোগিতা ও গুণাগুণ নিয়ে সরব হতে কুন্ঠিত নয়। কাশি এবং সর্দির উপসর্গ কমানো থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক মিষ্টি হিসেবে কাজ করা অবধি দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরি বাংলা ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যে একটি প্রচলিত নাম হয়ে উঠেছে, এবং তালমিছরির সাথে দুলাল চন্দ্র ভড়ের নামও চিরতরের মত ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে।
একজন উদ্যোক্তা হিসেবে দুলাল চন্দ্র ভড়ের কাহিনী সাহস, প্রতিশ্রুতি এবং বিশ্বে তাঁর ছাপ ফেলে রাখার ইচ্ছার উদাহরণ, যা তিনি নিশ্চিতভাবেই করতে সফল হয়েছিলেন।
0 Comments